সামপ্রদায়িকতা এবং মৌলবাদ মুক্ত বাংলাদেশ। আমাদের করণীয়।

মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা শুধু বাংলাদেশ কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যা নয়, সমগ্র বিশ্ব আজ জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসের হিংস্র থাবায় ক্ষতবিক্ষত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন দেশে উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অধিকারবঞ্চিত নিপীড়িতজনের সংগ্রাম এবং স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় মানুষের চৈতন্যে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক চেতনার পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক মূল্যবোধ মানুষের মনোজগতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষ পর্বে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিপর্যয় দেশে দেশে শোষণ ও বৈষম্যমূলক অমানবিক ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে যেমন শক্তিশালী করেছে- মনোজগতেও মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় হয়েছে। গত তিন দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দক্ষিণপন্থার ক্ষেত্র ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে, এবং বামপন্থার ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হচ্ছে। মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত মুসলিমপ্রধান দেশসমূহে সত্তরের দশকের শুরু থেকেই ধর্মীয় গোঁড়ামি, উগ্রতা এবং ইসলামের নামে সন্ত্রাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুসলিম বলয়ের যে সব দেশে বহুকাল ধর্মনিরপেক্ষ সরকার ক্ষমতায় ছিল, সে সব দেশে আজ মৌলবাদী কিংবা মৌলবাদবান্ধব সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই দলের সরকার এখন মৌলবাদ ও উদারনৈতিকতার দোলাচলে অবস্থান করছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিস্ময়কর বিশাল বিজয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রাষ্ট্র পরিচালনার ম্যান্ডেট যেমন দিয়েছে, একইভাবে রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত শেকড় উপড়ে ফেলার ম্যান্ডেটও দিয়েছে। তবে এই শেকড় ওপড়ানোর প্রশ্নে সরকারের নীতিনির্ধারকদের ভেতর মতদ্বৈধতা রয়েছে। যদিও এ কথা সবাই স্বীকার করেন- মৌলবাদের শেকড় উৎপাটন না করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়া যাবে না। ১৯৭১ সালে বিশ্বের মানচিত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে যে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছিল তার মূলনীতি ছিল ‘গণতন্ত্র’, ‘সমাজতন্ত্র’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘জাতীয়তাবাদ’- যাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ মানুষকে শহীদ হতে হয়েছিল, যাদের স্বপ্ন ছিল এদেশে ধর্মের নামে কোনও শোষণ-পীড়ন-বঞ্চনা থাকবে না। ১৯৭২ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের কারণ হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ধর্মের নামে হত্যা, শোষণ, পীড়ন বন্ধের জন্য এবং ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার জন্য ধর্মকে রাজনীতি ও রাষ্ট্র থেকে পৃথক রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে গোটা জাতির প্রত্যাশা ছিল ভবিষ্যতে ধর্মের নামে গণহত্যা ও নারীনির্যাতনসহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধকে আর বৈধতা দেয়া হবে না, যেমনটি হয়েছিল ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে। সেই প্রত্যাশা আজও অধরা রয়ে গেছে। একটি ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণের জন্য স্বাধীনতার বেদিমূলে ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-বিত্ত-নির্বিশেষে ৩০ লাখ মানুষের আত্মাহুতির দ্বিতীয় উদাহরণ বিশ্বে আর কোথাও নেই। বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক মাথা উঁচু করে এ অহংকার করতেই পারে স্বাধীনতার জন্য, ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য সর্বোচ্চ মূল্য আমরা দিয়েছি, যদিও এ অহঙ্কার বার বার বিপর্যস্ত হয়েছে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আমাদের শত্রু ছিল পাকিস্তানের সামরিক জান্তা এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা, যাদের প্রধান দলের নাম জামায়াতে ইসলামী। ১৯৪১ সালে অবিভক্ত ভারতবর্ষে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আবুল আলা মওদুদী (১৯০৩১৯৭৯)। প্রথম জীবনে তিনি একজন ধর্মপ্রচারক ও কোরান ও হাদিসের ব্যাখ্যাকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেও তার প্রকৃত লক্ষ্য ছিল ক্ষমতায় যাওয়া। ধর্মকে তিনি রাজনৈতিক মতবাদ প্রচারের হাতিয়ার মনে করতেন। নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য মওদুদী কোরাণ ও হাদিসকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন সেখানে আধ্যাত্মিকতার কোনও স্থান ছিল না। তিনি ধর্মকে ক্ষমতায় যাওয়ার বাহন বানিয়েছিলেন। তার মতে ধর্ম প্রচার করতে হলে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল করতে হবে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জিহাদ করতে হবে এবং রাষ্ট্র পরিচালিত হবে আল্লাহর আইনের দ্বারা। মওদুদীর মতে জিহাদ বিধর্মীর বিরুদ্ধে যেমন পরিচালিত হতে পারে, স্বধর্মী যারা তাকে বা তার দলকে বাধা দেবে তাদের বিরুদ্ধেও হতে পারে এবং দুনিয়ায় আল্লাহর হুকুমত কায়েম করার জন্য প্রত্যেক মুসলমানকে তার দলে যোগ দিতে হবে, যে দল আল্লাহর সেনাবাহিনী হিসেবে কাজ করবে। ভারতবর্ষে যে সুফীসাধকরা শান্তি ও সহমর্মিতার ইসলাম প্রচার করেছিলেন, যারা ধর্মের নামে মানুষের ভেতর বিভাজন ও বৈষম্যের বিরোধী ছিলেন, মওদুদীর বিবেচনায় তারা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গিয়েছেন। যে কারণে সুফীদের মাজার জেয়ারত বা মাজারকেন্দ্রিক বিভিন্ন কার্যক্রমকে মওদুদী হারাম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। গত দেড় দশকে মওদুদীর অনুসারীরা এই উপমহাদেশে সুফীদের বহু মাজারে বোমা হামলা করেছে, হত্যা করেছে মাজারে আগত শত শত ভক্তদের। মওদুদী গান বাজনাকেও হারাম বলেছেন, এমনকি সে গান যদি সুফীদের লেখা আল্লাহ বা রসুলের বন্দনাও হয়। মওদুদীবাদ ভিন্নমত, ভিন্নধর্ম, ভিন্ন জীবনধারা কোন কিছু বরদাশত করে না। ‘মুরতাদ কি সাজা’ পুস্তিকায় মওদুদী কোরান হাদিসের বিস্তর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন- এদের একমাত্র শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদ-। ইসলাম সম্পর্কে কট্টর ও রুক্ষ এই ধারণা মওদুদী আবিষ্কার করেননি। তার দু’শ বছর আগে আরবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মুহাম্মদ বিন আবদাল ওয়াহাব (১৭০৩-১৭৮২), যার অনুসারীরা ওয়াহাবি নামে পরিচিত। আধুনিক শিল্পবিপ্লবের যুগে, যখন ধর্মরাষ্ট্র, রাজতন্ত্র, উপনিবেশবাদ ও সামন্তবাদের শৃঙ্খল ভেঙে মানুষ নতুন রাজনৈতিক চেতনার দিগন্ত উন্মোচন করছে, তখন মুহাম্মদ বিন ওয়াহাব ইসলামকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল এবং রাষ্ট্র পরিচালনার চাবিকাঠি ঘোষণা করে সৌদি রাজতন্ত্রের আদর্শিক ভিত নির্মাণ করেছিলেন। বর্তমান যুগে ইসলামের নামে রাজনীতি ও সন্ত্রাসের জন্মদাতা হচ্ছেন মুহাম্মদ বিন ওয়াহাব, যার মতবাদ ওয়াহাবিবাদ হিসেবে সুপরিচিত। রাজনৈতিক মতবাদ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মুহাম্মদ বিন ওয়াহাব ইসলামের শুদ্ধিকরণের জন্যও জিহাদকে আবশ্যিক ঘোষণা করেছিলেন। মাজার জেয়ারত, মিলাদ মাহফিল, সুফীদের আধ্যাত্মিক সাধনাÑ সব কিছু তার বিবেচনায় ছিল ইসলামবিরোধী। তিনি যথার্থভাবেই উপলব্ধি করেছিলেনÑ সুফীদের আধ্যাত্মিক মানবিক ইসলাম তার জঙ্গী মৌলবাদী রাজনৈতিক ইসলামের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হবে। মহানবী হযরত মুহাম্মদের প্রথম সাহাবাদের অন্যতম হযরত জায়েদ বিন আল খাত্তাবের (খলিফা হযরত উমরের অগ্রজ) মাজার ধ্বংসের জন্য ওয়াহাব রীতিমতো জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন এবং এ কাজে সৌদি রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ বিন সৌদের সঙ্গে চুক্তিও করেছিলেন। ১৯২৮ সালে মিশরের হাসান আল বান্না (১৯০৬-১৯৪৯) ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ (ইখওয়ানুল মুসলেমিন) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাম্প্রতিক কালে উত্তর আফ্রিকায় যে ওয়াহাবি রাজনীতির সূচনা করেছেন, একই কাজ আবুল আলা মওদুদী করেছেন দক্ষিণ এশিয়ায় ‘জামায়াতে ইসলামী’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ‘ওয়াহাবিবাদ’ ও ‘মওদুদীবাদ’ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকলে বাংলাদেশ বা বিশ্বের অন্যত্র ইসলামী মৌলবাদ বা ধর্মের নামে সন্ত্রাস মোকাবেলার ব্যবস্থাপত্র প্রণয়ন করা সম্ভব হবে না। ॥ দুই ॥ ধর্মীয় মৌলবাদ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে দুই ধরনের বিচ্যুতি আমরা লক্ষ্য করি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সর্বত্র সরকারের বিভিন্ন বাহিনী জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসকে অন্য সব সন্ত্রাসের মতোই আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে। ‘আল কায়দা’, ‘আইএস’ বা ‘জামায়াতে ইসলামী’ যেন মাফিয়ার মতো সন্ত্রাসী সংগঠন, যা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নির্মূল করা যায়। এ কথা আমরা বার বার বলেছি ইসলামের নামে, বা অন্যান্য ধর্মের নামে বিশ্বব্যাপী যে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী কর্মকা- সংঘটিত হচ্ছে তা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলেও এই ধরনের সন্ত্রাস নির্মূলের জন্য প্রয়োজন ধারাবাহিক ও বহুমাত্রিক আদর্শিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। ধর্মের নামে জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাস নির্মূলনের ব্যবস্থাপত্র প্রণয়নের ক্ষেত্রে আরেকটি বিচ্যুতি হচ্ছে ধর্মকে সম্পূর্ণভাবে খারিজ করা। এই মতবাদের প্রচার করা মনে করেন যেহেতু সন্ত্রাস বা সংঘাত সংঘটিত হচ্ছে ধর্মের নামে, সেহেতু ধর্ম যদি না থাকে তাহলে সন্ত্রাস বা সংঘাতও থাকবে না। ধর্মের নামে সন্ত্রাস মোকাবেলার এই ধারণা অনেকটা মাথাব্যথার উপশমের জন্য মাথা কেটে বাদ দেয়ার নিদানের মতো। বর্তমানে বিশ্বে সাতশ কোটি মানুষের ভেতর প্রায় ছয়শ কোটি মানুষ কোন না কোন ধর্মের অনুসারী, যারা ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার পছন্দ করেন না। এটা ঠিক যে ওয়াহাবিবাদী ও মওদুদীবাদীরা ধর্মীয় গ্রন্থের অনেক বয়ান রাজনৈতিক ইসলাম- তথা সন্ত্রাসকে বৈধতা দেয়ার জন্য ব্যবহার করে থাকেন। তাদের মতে কোরান-হাদিসের যে ব্যাখ্যা তারা করেন সেটা সম্পূর্ণ অভ্রান্ত, যারা এর বিরোধিতা করেন তারা নাস্তিক, মুরতাদ বা কাফের। ইসলাম সম্পর্কে তাদের এই ব্যাখ্যার কারণে অনেকে এই ধর্মকে সন্ত্রাসের সমার্থক মনের করেন। বিশ্বের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমান ইসলামকে সন্ত্রাসের ধর্ম নয়, শান্তি ও মানবতার ধর্ম হিসেবে পালন করেন। বিশ্বের তাবৎ অমুসলিমরা তো বটেই, শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানও মনে করেন ওয়াহাবিবাদ বা ‘মওদুদীবাদ’-এর যাবতীয় অভিব্যক্তি নিষিদ্ধ না হলে ধর্মের নামে সন্ত্রাস থেকে আমরা কখনও মুক্তি পাব না। জামায়াতে ইসলামীর মতো রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষণা অত্যাবশ্যক বটে, তবে দল নিষিদ্ধ হলেই মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার অভিশাপ থেকে দেশ ও সমাজ মুক্তি পাবে- এ কথা বলা যাবে না। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণ করতে হলে মওদুদীবাদ ও ওয়াহাবিবাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, দার্শনিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি নিষিদ্ধ করতে হবে। এর পাশাপাশি ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনে ধর্মনিরপেক্ষ মানবিকতা ও বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার ঘটাতে হবে। ধর্মপরায়ণতা ও ধর্মান্ধতা এক নয়। ধর্মান্ধতার বিরোধিতা করার অর্থ ধর্মের মানবিক চরিত্রের বিরোধিতা করা নয়। আমরা মুক্তচিন্তার পক্ষে। মুক্তচিন্তার ওপর আঘাত যে মহল থেকে আসুক না কেন তা প্রতিহত করতে হবে। তবে ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে যেমন কিছু বিধিনিষেধ মানতে হয়, আমাদের সমাজে মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রেও সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি কিছু দায়িত্ববোধ থাকা প্রয়োজন। পশ্চিমের সমাজ ধর্ম বা অন্যান্য বিশ্বাসের পক্ষে/বিপক্ষে যতটা উদার, প্রাচ্যের সমাজে সেই উদারতা বহুলাংশে অনুপস্থিত। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার ব্যাধি থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রকে মুক্ত করতে হলে স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় রেখে ব্যবস্থাপত্র প্রণয়ন করতে হবে। ধর্মীয় মৌলবাদের প্রধান অভিব্যক্তি হচ্ছে ধর্মের আচার-নিষ্ঠার ক্ষেত্রে গোঁড়ামি, উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতা। একইভাবে রাষ্ট্রিক বা নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবোধ যদি সীমা লঙ্ঘন করে জাত্যাভিমানে পরিণত হয় তা ধর্মীয় মৌলবাদের মতোই বিপজ্জনক, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের উত্থানপর্বে আমরা ইউরোপে দেখেছি। জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয়ের মতো মানুষের ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিক পরিচয়ের ক্ষেত্রেও সীমা নির্ধারণ করা আছে, যা অস্বীকার করলে সাম্প্রদায়িক বোধ মানুষকে আচ্ছন্ন ও অসহিষ্ণু করে, অন্তিমে সমাজে বিদ্বেষ, বৈষম্য, বিরোধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। ধর্ম-বর্ণ-জাতিসত্তা-ভাষা-আঞ্চলিকতা নির্বিশেষে মানুষে মানুষে সংঘাত ও হানাহানির অবসান ঘটাতে হলে সব ধরনের মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার শেকড় খুঁজে বের করে তা সমূলে উৎপাটন করতে হবে। এই শেকড় রাষ্ট্রের সংবিধানে থাকতে পারে, সমাজদেহে থাকতে পারে, মানুষের মনোজগতের থাকতে পারে। কর্কট ব্যাধির মতো এই শেকড় রাষ্ট্র, সমাজ ও মানুষের সমূহ যন্ত্রণা ও মৃত্যুর কারণ হয়। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর প্রধান সহযোগী যারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, নতুন প্রজাতন্ত্রের অনন্যসাধারণ সংবিধান রচনা করেছেন, তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকা-ের উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অভিসারী জাতিকে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার কৃষ্ণ গহ্বরে নিক্ষেপ করা। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের নেপথ্য নায়ক ও প্রধান বেনিফিসিয়ারি হচ্ছেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে সবার আগে তিনি জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগীদের পুনর্বাসনের জন্য অনেক কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলেন। এর অন্যতম হচ্ছেÑ ’৭২-এর সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল বা যে কোন সংগঠন প্রতিষ্ঠার উপর যে সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা ছিল তা বাতিল করা, সংবিধানের তথাকথিত ‘ইসলামীকরণ’ বা ‘পাকিস্তানীকরণে’র উদ্দেশে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ বাতিল করা, ৬৬টি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে বাংলাদেশে রাজনীতি করার জন্য অনুমোদন প্রদান, সংবিধানের মুখবন্ধে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহ’র উপর পূর্ণ বিশ্বাস…’ ইত্যাদি সংযোজন করা এবং তথাকথিত মুসলিম উম্মাহর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করা। অবৈধ ক্ষমতাদখলকে বৈধতা প্রদান এবং আন্তর্জাতিক মুসলিম উম্মাহর সমর্থন লাভের জন্য জিয়া স্বাধীন বাংলাদেশে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবৃক্ষের বীজ বপন করেছিলেন আজ তা ফলজ মহীরুহে পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে ওয়াহাবিবাদ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা না পেলেও পাকিস্তান আমলে এবং ’৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশে জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকার এবং জিয়াপতœী খালেদার আধাসামরিক সরকার ওয়াহাবিবাদ ও মওদুদীবাদকে নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। সরকারের সহযোগিতা না পেলে মৌলবাদ কোনও দেশে এত শক্তি অর্জন করতে পারে না। ॥ তিন ॥ বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী আত্মপ্রকাশের পর সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে শত শত কোটি টাকা এনেছে মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত মাদ্রাসা ও মসজিদ পুনর্নির্মাণ এবং কোরান শরিফ ছাপার জন্য। তখন জামায়াত নেতারা মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে আরব শেখদের বুঝিয়েছেন- ভারত ইসলাম ধ্বংসের জন্য পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ বানিয়েছে। নয় মাসের যুদ্ধের সময় ভারতীয় সৈন্য এবং তাদের এদেশীয় এজেন্ট মুক্তিবাহিনী সব মাদ্রাসা মসজিদ ধ্বংস করেছে, বাংলাদেশে কোনও কোরান শরিফ নেই। তারা আরও বলেছেন- ইসলাম ও পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার জন্য জামায়াতের রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর হাজার হাজার নওজোয়ান শহীদ হয়েছে, তাদের পরিবারের পুনর্বাসনের জন্যও প্রচুর টাকা প্রয়োজন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রাপ্ত বিপুল অর্থ জামায়াত বিভিন্ন শিল্প, বাণিজ্য, পরিবহন ও আবাসন খাতসহ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায় বিনিয়োগ করে বিশাল অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। জামায়াতে ইসলামীর সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠান সরকার যদি অধিগ্রহণ না করে তাহলে শুধু দল নিষিদ্ধ করে কোন লাভ হবে না। অর্থের জোরে ব্যাঙের ছাতার মতো জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন একের পর এক গজাতে থাকবে। ১৯৭৫-এর পর থেকে বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যে অদক্ষ জনশক্তি রফতানি আরম্ভ করে। এরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে পেট্রোডলার যেমন এনেছে, একইভাবে সৌদি ওয়াহাবি সংস্কৃতি ও জীবনধারাও বাংলাদেশে আমদানি করেছে। বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ঘটেছে এক হাজারেরও বেশি বছর আগে। সুফী সাধকরা বাংলাদেশসহ গোটা উপমহাদেশে ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণভাবে স্থানীয় ধর্ম, সামাজিক ও লৌকিক রীতিনীতির সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হননি। তাদের ইসলামে এক ধরনের সমন্বয়ের উদ্যোগ ছিল। প্রচলিত হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম এবং লোকায়ত সংস্কৃতির অনেক উপাদান তারা গ্রহণ করেছিলেন। যে কারণে ভারতবর্ষে ইসলাম এত দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে। কট্টরপন্থী ওয়াহাবি মোল্লারা বিভিন্ন সময়ে ইসলাম ধর্মকে শুদ্ধিকরণের চেষ্টা করেছেন বটে তবে বাংলার মানুষ ধর্মের নামে উগ্রতা কিংবা গোঁড়ামি কখনও অনুমোদন করেনি। এমনকি হাজী শরিয়তউল্লাহদের হিন্দু জমিদার ও ইংরেজবিরোধী ওয়াহাবি বা ফারায়েজি আন্দোলন মুসলমান কৃষক কিংবা শহুরে মধ্যবিত্তের কিছু সমর্থন পেলেও তাদের ধর্ম সংস্কারের কট্টর দাবির প্রতি তেমন জনসমর্থন কখনও ছিল না। ওয়াহাবিরা মিলাদ ও মাজার জেয়ারতকে যতই বেদাত বা পূজা বলুক না কেন সাধারণ মানুষ কখনও তা সমর্থন করেনি। সৌদি ওয়াহাবি সংস্কৃতির আগ্রাসনের কারণে বাংলাদেশের চিরায়ত বাঙালী সংস্কৃতি আজ হুমকির সম্মুখীন। তরুণরা আকৃষ্ট হচ্ছে ‘আল কায়দা’, ‘আইএস’-এর ইসলামের নামে সন্ত্রাসের প্রতি। ১৯৭৫ এর পর বাংলাদেশে সৌদি বোরখার আমদানি শতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। হজের মৌসুম ছাড়াও প্রতি বছর হজযাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে। পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে কথ্য ভাষার ক্ষেত্রেও। সত্তর দশকেও মুসলমানরা বিদায় নেয়ার সময় ‘খোদা হাফেজ’ বলতেন। ‘খোদা হাফেজ’, এখন ‘আল্লাহ হাফেজ’ হয়ে আর বিভাষীদের হাসির খোয়াক জোগাচ্ছে। নামাজকে এখন ‘সালাত’ বলা হচ্ছে। রমজান মাসকে বলা হচ্ছে ‘রামাদান। রোজাকে আরবিতে ‘সিয়াম’ বলা হচ্ছে। বাংলা কথ্যভাষার আঙ্গিনায় ‘ইনশাল্লাহ’, ‘মাশআল্লাহ’, ‘সোবহান আল্লাহ’, ‘আলহামদুলিল্লাহ’ যেভাবে অনুপ্রবেশ করেছেÑ যেন আরবি ভাষা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা আল্লাহ বোঝেন না। ‘খোদা’ ফারসি শব্দ হওয়ায় ‘আল্লাহ’কে ‘খোদা’ সম্বোধন করা ওয়াহাবি সংস্কৃতিতে নাজায়েজ হয়ে গেছে। মাথায় ঘোমটা দিলে চলবে না, শাড়ির সঙ্গে মেয়েদের হিজাব পরা ক্রমশ বাধ্যতামূলক হয়ে যাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় ‘হিজাব সুন্দরী’ প্রতিযোগিতা হচ্ছে, শিরোপা দেয়া হচ্ছে শ্রেষ্ঠ হিজাব পরিধানকারীদের। কয়েক বছর আগে হাটহাজারির এক গ্রামে শুটিং করতে গিয়ে অভিনব অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ‘জিহাদের প্রতিকৃতি’ প্রামাণ্যচিত্রে মায়ানমারে জিহাদ করতে গিয়ে ‘শহীদ’ হয়েছে এমন এক তরুণের পিতার সাক্ষাতকার ধারণ করার জন্য আমরা দুর্গম সেই গ্রামে গিয়েছিলাম। দুর্গম বলছি এ কারণে যে গাড়ি নিয়ে সেখানে যাওয়া যায় না। আমরা দুটি ক্যামেরা, স্ট্যান্ড, লাইট নিয়ে সাত-আটজন যাচ্ছিলাম। গ্রামের দিক থেকে আসা দুজন বোরখাধারী মহিলা আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। আমরা তাদের চেহারা না দেখলেও তারা আমাদের বিলক্ষণ দেখেছিলেন। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের কথোপকথন কানে এল। একজন তার সঙ্গিনীকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাংলায় প্রশ্ন করেছিলেনÑ এরা আমাদের গ্রামে ক্যামেরা নিয়ে কোথায় যাচ্ছে? আমাদের গ্রামে তো সবাই ওয়াহাবি। সঙ্গিনী জবাব দিয়েছিলেনÑ বোধহয় আমাদের গ্রামে কেউ সুন্নি হয়ে গিয়েছে। আমার ধারণা ছিল ওয়াহাবিবাদ বুঝি শহুরে শিক্ষিতজনের চর্চার বিষয়। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যে এর শেকড় বিস্তৃত হয়েছে হাটহাজারির সেই গ্রামে না গেলে জানতে পারতাম না। তবে সব বোরখাধারিণী ওয়াহাবি এটা মনে করার কোন কারণ নেই। নির্বাচনের সময় গ্রামে গ্রামে জামায়াতি এনজিওগুলো বিনামূল্যে মহিলাদের বোরখা ও ছেলেদের গলায় ঝোলানোর স্কার্ফ দেয়। যে মেয়ের বাইরে পরার মতো একখানা শাড়ি নেই, সে বিনামূল্যে পাওয়া বোরখা স্বাভাবিকভাবেই লুফে নেবে। তবে এভাবে যে হিজাব বা বোরখার প্রতি আসক্তি ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে এতেও কোনও সন্দেহ নেই। সৌদি ওয়াহাবি সংস্কৃতির আগ্রাসন প্রতিহত করতে হলে অসাম্প্রদায়িক বাঙালী সংস্কৃতির প্রসার ঘটাতে হবে। মৌলবাদ মনোজগতে অন্ধকারের আধিপত্য বিস্তার করে। সাম্প্রদায়িকতা মানুষের মনকে সঙ্কীর্ণ থেকে সঙ্কীর্ণতর করে যাবতীয় মানবিক মূল্যবোধ ধ্বংস করে। চেতনার জগতে অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর লড়াই তীব্রতর করতে হলে, মানুষের ভালবাসা ও সহমর্মিতা পেতে হলে মানুষকে ভালবাসতে হবে শর্তহীনভাবে। মানুষের সকল আচরণ ও কার্যক্রমের সীমানা নির্ধারিত রয়েছে। নিজের বিশ্বাস, আচরণ বা কর্মকা- যদি অন্যের ক্ষতির কারণ হয় কিংবা হৃদয়বৃত্তি সঙ্কুচিত করেÑ তা অবশ্যই পরিহার করতে হবে। রাষ্ট্রের আচরণ ও বিধান যা সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকে, তা যত উদার ও গণতান্ত্রিক হোক না কেন মনোজগতে ধর্মনিরপেক্ষ মানবিকতার আধিপত্য স্থায়ী না হলে অন্ধকারের বোধ ব্যক্তি থেকে সমাজে, সমাজ থেকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় সংক্রমিত হয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ড. কুদরতে খোদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। কমিশন সুপারিশ করেছিলÑ রাষ্ট্রের চার মূলনীতি শুধু সংবিধানে থাকলে চলবে না। বিদ্যালয়ের প্রাথমিক পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শ্রেণী পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তারা সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়নের প্রস্তাব করেছিলেন। কুদরতে খোদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের আগেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তাঁর শিক্ষানীতিকে চিরদিনের জন্য মর্গে পাঠিয়ে বাংলাদেশে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটানো হয়েছে। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ছিলেন ড. কুদরতে খোদা শিক্ষা কমিশনের সদস্য সচিব।