পুনর্গঠনের এই প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত কঠিন। কারণ, ক্ষমতাসীন সরকার শুধু বাইরে থেকে নয়, নির্মূল কমিটির ভেতরেও তাদের অনুচরদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিল। যাদের লক্ষ্য ছিল আন্দোলনের স্বাভাবিক মৃত্যু। বাংলাদেশে এর আগে সিভিল সমাজের বহু উদ্যোগ কিছুদিন পর কিভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে সে অভিজ্ঞতা আমাদের ছিল। যে কারণে নির্মূল কমিটি পুনর্গঠনের সময় আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি নতুন প্রজন্মকে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে এবং দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের আরও বেশি সম্পৃক্ত করতে। বিগত বছরগুলোতে আমাদের কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করলে বোঝা যাবে এ কাজে আমরা কতটা সফল হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য ১৯৯৫ সাল থেকে আমরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের বইয়ের পাঠাগার প্রতিষ্ঠা আরম্ভ করেছিলাম। ২০০১ সাল পর্যন্ত সারাদেশে আমরা ৮০টি পাঠাগার স্থাপন করেছিলাম। যে সব পাঠাগারকে কেন্দ্র করে প্রত্যন্ত সেই সব অঞ্চলে বিস্তৃত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক সামাজিক সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। এই কাজে যে পরিমাণ শ্রম, মেধা ও অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে গণআদালতের কর্মসূচী সফল করার জন্য, তার এক দশমাংশও প্রয়োজন হয়নি। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে ২০০১ সালে নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে সুপরিকল্পিতভাবে আমাদের পাঠাগারগুলো ধ্বংস করে দেয়। যা আজও পুনরুজ্জীবিত করতে পারিনি। ১৯৯৫ সালে নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার সময় আমাদের বিবেচনায় রাখতে হয়েছে ঢাকা শহরে বিশাল বিশাল সমাবেশ করে মৌলবাদের মু-ুপাত করে যত জ্বালাময়ী ভাষণই আমরা দিই না কেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে মৌলবাদের ঘাঁটিতে যদি না আঘাত করা যায় তাহলে এই অপশক্তিকে প্রতিহত করা সম্ভব হবে না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার ফলে যে সুবিধা পেয়েছি, সেটা হচ্ছে আমাদের প্রত্যন্ত এলাকার নেতাকর্মীদের পুলিশি নির্যাতন ও হয়রানির কারণে ঘরছাড়া হতে হয় না। আমরা নির্বিঘেœ দুর্গম প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরতে পেরেছি এবং এখনও পারছি। শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম আমলে আমাদের একটি বড় সাফল্য ছিল ২০০১ সালের ১-২ জুনে ঢাকায় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে পাঁচ দেশীয় দক্ষিণ এশীয় সম্মেলনের আয়োজন। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের শতাধিক শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়বার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। সম্মেলনে এয়ার মার্শাল (অব) আসগর খানের নেতৃত্বে আগত পাকিস্তানের বরেণ্য সাংবাদিক, অধ্যাপক, কবি, পেশাজীবী ও মানবাধিকার নেতৃবৃন্দ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছেন এবং পাকিস্তানে এই দাবির সমর্থনে জনমত সংগঠনের কথা বলেছেন। সম্মেলনের শেষে গৃহীত ঢাকা ঘোষণায়ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলা হয়েছে। এই সম্মেলনে গঠিত হয়েছে ‘মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলন, যা নির্মূল কমিটির উদ্যোগ ছাড়া সম্ভব হতো না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে যেভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভ করেছে, এটিকে আমাদের আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য সাফল্য বলে মনে করি। ২০১০ সালে এবং ২০১৭ সালে আমরা ২০০১-এর চেয়ে অনেক বড় পরিসরে ঢাকায় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছি। এর ধারাবাহিকতায় আমরা ইউরোপ ও আমেরিকায় অনেক আন্তর্জাতিক সম্মেলন করেছি ’৭১-এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পাশাপাশি গণহত্যাকারীদের বিচারের দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের এই আন্দোলন আমাদের বহু দূর পর্যন্ত এগিয়ে নিতে হবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা- ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক, মানবিক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার স্বপ্ন। আন্দোলনের তিন দশক উদযাপনের সময় আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ও কবি সুফিয়া কামালসহ আমাদের সহযোদ্ধাদের- এই সময়ে যাঁদের হারিয়েছি। আহ্বান জানাই তরুণ প্রজন্মকে আন্দোলনের দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য। এই আন্দোলনের সামাজিক মাত্রা রয়েছে। সাংস্কৃতিক মাত্রাও রয়েছে। কিন্তু জাহানারা ইমামের আন্দোলনের চরিত্র মূলত রাজনৈতিক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় সঙ্কীর্ণতার উর্ধে উঠে ’৭১ আর ’৯২-এর মতো একজোট হয়ে এক মঞ্চে না দাঁড়ালে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার অভিশাপ থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করা যাবে না।